আবাসন খাতে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যাংক স্বাভাবিক ব্যাংকিং কর্মকা- চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে এবং আন্তঃব্যাংক কলমানির দ্বারস্থ হচ্ছে। অনেকেই আবার নতুন ঋণ বিতরণ বন্ধ রেখেছে। চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ বিতরণও করতে পারছে না কেউ কেউ। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে ঋণ ও আমানত রেশিও (এডিআর) সমন্বয়, ডলার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা, ফারমার্স ব্যাংক-কা-ে সৃষ্ট আস্থাহীনতায় বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেওয়া ও ব্যাসেল-৩ আওতায় বাড়তি মূলধন সংরক্ষণ করতে গিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে হওয়ায় সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের পরিবারের টাকা নতুন করে ব্যাংকিং সিস্টেমে আসছে না। যেগুলো ব্যাংকে রাখা আছে, তাও তুলে নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাংকে তারল্য সংকটের প্রভাব দেশের পুঁজিবাজারে ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সেখান থেকে রেহাই পাচ্ছে না আবাসন খাতও। ব্যাংকিং খাতে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে আমানতের সুদের হার, যার প্রভাব ইতোমধ্যে আবাসন খাতেও আঁচ লেগেছে। পাশাপাশি সিন্ডিকেট করে রডের দাম বৃদ্ধিতে আবাসন খাতে দীর্ঘমেয়াদি শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বিভিন্ন ব্যাংক সূত্র জানায়, তারল্য সংকটে আমানতের সুদের হার বৃদ্ধির ফলে তাদেরও সুদের হার বাড়াতে হচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবাসন ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট থাকলেও তা বর্তমানে ডাবল ডিজিটে পৌঁছে গেছে। গত ডিসেম্বর মাসে ডিবিএইসের সুদ হার সাড়ে ৮-৯ শতাংশের মধ্যে ছিল, বর্তমানে তা ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে এসআইবিএলের এ হার ১৪ শতাংশ, ফারমার্স ব্যাংকে ১৫, উত্তরা ব্যাংকে ১২ এবং এবি ব্যাংকে ১২ দশমকি ৫ শতাংশ।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেলার পর আবাসন খাতে সুবাতাস লাগতে শুরু করেছিল। কিন্তু রড-সিমেন্টর মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাংকঋণে সুদের হার বাড়ায় বড় ধরনের মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। রড ও সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ডেভেলপার কাজে গতি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সময়মতো ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে ব্যাংকের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটের সময় ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়েছিল। কিন্তু সুদহার বাড়ায় তারা আবার মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এ জন্য তিনি রড-সিমেন্টের মূল্য কমানোর পাশাপাশি সুদহার কমানোর পরামর্শ দেন।
সিন্ডিকেট করে রডের মূল্যবৃদ্ধি : সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এমএস রড তথা ইস্পাতসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি (বিএসিআই) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি গণপূর্ত ও বাণিজ্য বিভাগকে বিষয়টি দেখার অনুরোধ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বিএসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মুনীর উদ্দীন আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে হঠাৎ রডের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এক বছরের ব্যবধানে রডের মূল্য বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসেবে বিএসিআই সদস্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে আসছে। অতিসম্প্রতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের মূল উপাদান এমএস রডের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। আরও বৃদ্ধির প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজের গতি মন্থর হয়ে যাচ্ছে।
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেসব কারণ উল্লেখ করছে, তার মধ্যে রয়েছে- আন্তর্জাতিক বাজারে বিলেট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এ কারণ দেখিয়ে ইস্পাতসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ও নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রডের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে চলছে। প্রকৃতপক্ষে বিলেট দেশেই তৈরি হয়। আর খুব নগণ্য পরিমাণ বিলেট আমদানি হয়। বিলেটের কাঁচামালের দাম ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য, যা সামগ্রিকভাবে রডের মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে রডের মূল্য ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি অযৌক্তিক এবং অনৈতিক বলে মনে করছে অবকঠামো নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান রড প্রস্তুত করছে এবং দেশি চাহিদা মেটাচ্ছে। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। নতুন করে কোনো শুল্ককরও বৃদ্ধি করা হয়নি। ফলে রডের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে মনে করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আগামী নির্বাচনে সরকারের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে নির্মাণসামগ্রীর দামবৃদ্ধি করেছে বলে অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
পত্রে আরও বলা হয়, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গুণগতমান বজায় রেখে দ্রুত সম্পাদনের জন্য বদ্ধপরিকর। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অনতিবিলম্বে রোধ করা না হলে- এক. সরকারের নির্মাণ প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়বে। দুই. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির বাস্তব অগ্রগতি অর্জিত হবে না। তিন. সরকারের গৃহীত ভিশন-২০২১ও বিঘ্নিত হবে। চার. ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যাবে। যে কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্ঘলা বিঘ্নিত হবে এবং দেশে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। এমন অবস্থায় বাস্তবতার আলোকে রডের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ চায় বিএসিআই।