ড্যাপের কারণে স্থবির আবাসন খাত লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে নেতিবাচক প্রভাব

ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে আবাসন খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে (সংযোগ শিল্প) নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ২০০৮ সালের ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ ও ‘মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’ বাতিল করে বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ চালু করা হয়েছে, যা ভবন নির্মাণে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে এবং নগর উন্নয়নের গতি থমকে দিয়েছে।’
রিহ্যাব ও আবাসন খাতের সহযোগী শিল্পের বাণিজ্য সংগঠনগুলোর যৌথ আয়োজনে এ সংবাদ সম্মেলন থেকে অবসান ও সংযোগ শিল্পের স্থবিরতা থেকে অতি দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে সরকারকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, ‘নতুন ড্যাপের ফ্লোর এরিয়া রেশিও-সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের কারণে আবাসন খাতে মারাত্মক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে বিনিয়োগ কমেছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
এ শিল্পে সরাসরি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অথচ রডের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরো বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।’
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রিহ্যাব সভাপতি বলেন, ‘অস্থায়ী সরকার হলেও আবাসন খাত ও সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাত সচল না হলে জাতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা দেশের উন্নয়ন থমকে দিতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা জানান, ড্যাপ অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা ও আয়তন সীমিত হওয়ায় ভূমি মালিকরা ডেভেলপারদের হাতে ভূমি দিতে রাজি হচ্ছেন না। এতে করে নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে না, ফলে আবাসন খাতসহ এর সঙ্গে জড়িত ২০০টির বেশি লিংকেজ শিল্প যেমন রড, সিমেন্ট, ইট, কেবল, রঙ, টাইলস, লিফট, থাই অ্যালুমিনিয়াম ও স্যানিটারি সামগ্রীর বাজারে মারাত্মক মন্দা ভাব চলছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘আবাসন খাত ভালো থাকলে আমাদের সংশ্লিষ্ট লিংকেজ (সংযোগ) শিল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকার কথা। কিন্তু আমরা ভালো নেই, কারণ লিংকেজ শিল্পগুলোর সব শেষ ফিনিশ প্রডাক্টের বেশির ভাগ ক্রেতা ডেভেলপাররা।’
তিনি বলেন, ‘বৈষম্যমূলক ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে আবাসন শিল্প মারাত্মক সমস্যায় রয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে লিংকেজ শিল্পগুলোর ওপর। এসব শিল্পের পণ্যের চাহিদাও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। রডের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। একইভাবে চাহিদা কমেছে সিমেন্ট, ইটসহ অন্যান্য উপকরণেরও।’
রিহ্যাবের সহসভাপতি (ফাইন্যান্স) আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার আবাসনসংশ্লিষ্ট লিংকেজ কোম্পানিতে ৩৫০ লোক ছিল, কিন্তু বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৭৫ জন। বাকি কর্মীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল কেবলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আকতার হোসেন ঢালী বলেন, ‘আমরা দেশেই ৯৮ শতাংশ কেবল উৎপাদন করি, মাত্র ২ শতাংশ আমদানি করি। কিন্তু আবাসন প্রকল্প কমে যাওয়ায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
বাংলাদেশ এলিভেটর এক্সিলেটর অ্যান্ড লিফট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমদাদ উর রহমান জানান, বিল্ডিংয়ের উচ্চতা কমে যাওয়ায় লিফটের চাহিদা একেবারে কমে গেছে। এজন্য তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন শিল্পের প্রতিনিধিরা বলেন, অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার জন্য অবশ্যই আবাসন খাত এবং সংশ্লিষ্ট সংযোগ শিল্পের স্থবিরতা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায়, ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মো. নিয়াজ আলী চিশতি, বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ, বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হোসেন আলমগীর, বাংলাদেশ টিম্বার ইমপোর্টার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ তানভীর মোহাম্মদ দিপু এবং রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রিহ্যাবের পরিচালক ও প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ লাবিব বিল্লাহ্।