বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পাওনা ৪০০ কোটি টাকা
যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ পোশাক বিক্রেতা ডেবেনহ্যামসের ও অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান মোজাইকের কাছে তৈরি পোশাক রফতানি করে বিল আদায় করতে পারছে না দেশের ৬৮টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। এ কারণে একরকম পথে বসার উপক্রম হয়েছে তাদের।
বিভিন্ন সময় এসব কারখানা থেকে প্রতিষ্ঠান দুটি ৩ কোটি ৩ লাখ ডলার মূল্যের পোশাক ক্রয় করেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর পুরো অর্থই এখন অনাদায়ী। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতে না পারায় অধিকাংশ রফতানিকারকের ব্যবসা এখন বন্ধের পথে।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ পোশাক বিক্রেতা ডেবেনহ্যামসের কাছে পাওনা ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দাবি করেছে তিন ডজন পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন ডেবেনহ্যামস ভেন্ডরস কমিউনিটি। বাংলাদেশের ৩৬ পোশাক বিক্রেতা যুক্তরাজ্যের ১৫০ বছরের পুরোনো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ডেবেনহ্যামসের কাছে তৈরি পোশাক রফতানি করে। ডেবেনহ্যামস যুক্তরাজ্য ও পশ্চিমের বাজারে অত্যন্ত সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান। এজন্য বিক্রয় চুক্তির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হয়েছিল। রফতানি থেকে পাওয়া অর্থ ব্যাংকে আসার পর শর্ত অনুসারে বিল অব লেডিং মনোনীত প্রতিনিধি ইএফএলের কাছে জমা দেওয়ার শর্ত ছিল। এসব শর্ত মেনেই রফতানিকারকরা গত এক দশক ধরে পণ্য রফতানি করে আসছিলেন বলে জানানো হয়।
ডেবেনহ্যামস ভেন্ডরস কমিউনিটির আহ্বায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফরওয়ার্ডার এক্সপো ফ্রেইট লিমিটেডের (ইএফএল) গাফিলতির কারণে বকেয়া টাকা পাওয়া যায়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এই ব্রিটিশ পোশাক বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করবেন তারা।
এক্সপো ফ্রেইট লিমিটেড এখন দেউলিয়া ডেবেনহ্যামসের চালান পরিচালনার সময় রফতানিকারীদের বকেয়া পরিশোধের জন্য আইনত দায়বদ্ধ উল্লেখ করে মো. জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, আমরা নিরলসভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। কিন্তু ইএফএলের গাফিলতির কারণে আমরা আজও বাকি টাকা পাইনি।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বন্দর ও ট্রানজিটে পড়ে থাকা পণ্যের বিষয়ে আলোচনা, যোগাযোগ, পাওনা আদায় ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়া। এই ৩৬ জন রফতানিকারকের মধ্যে যাদের মোট রফতানি বার্ষিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি, তাদের মধ্যে অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানও আছে। তারা এই লোকসান বহন করতে সক্ষম নয়। যথাসময়ে বকেয়া পরিশোধ করা না হলে রফতানিকারকরা অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়বেন।
প্রায় ২২টি বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকের পাওনা ১৯ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেনি অস্ট্রেলিয়ার ফ্যাশন রিটেইলার মোজাইক ব্র্যান্ডস লিমিটেড। এতে সংকটে পড়েছেন রফতানিকারকরা। মোজাইক কর্তৃপক্ষ এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সুফল মিলছে না। বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে কিছুই করার নেই বলে পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অর্থ আদায়ে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি আবারও ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নারদিয়া সিমপসনের কাছে চিঠি লিখেছে সরকার নিযুক্ত বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন। চিঠিতে বলা হয়েছে- গত ৯ মার্চ এবং ২৮ সেপ্টেম্বর– দুই দফায় বিজিএমইএ ১৬টি কারখানার প্রায় ১৪৯ কোটি ডলার অনাদায়ী অর্থ আদায়ে সহযোগিতা চেয়ে হাইকমিশনকে অনুরোধ জানায়। অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ওই অনাদায়ী পরিস্থিতির মধ্যেই মোজাইকের কাছে আরও ৭টি কারখানার প্রায় ৫০ লাখ ডলার পাওনার তথ্য জানিয়েছেন রফতানিকারকরা। এ কারখানাগুলোর অস্তিত্ব এবং লাখো শ্রমিকের রুটি-রুজির স্বার্থে সব পাওনাদি আদায়ে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। চিঠির সঙ্গে কারখানার বিস্তারিত এবং মোজাইকের সঙ্গে লেনদেন ও যোগাযোগর সব তথ্য দেওয়া হয়।
নিজের দেশের ব্র্যান্ড মোজাইকের কাছ থেকে পাওনা আদায়ের অনুরোধের জবাবে কিছুদিন আগে বিজিএমইএর কাছে পাঠানো চিঠিতে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন বলেছে, বিষয়টি নিয়ে তারা ইতোমধ্যে ক্যানবেরায় যোগাযোগ করেছে। এতে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি মারাত্মক আর্থিক সংকটে রয়েছে। এ কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের রফতানিকারকদের পাওনা পরিশোধেও একই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। পাওনা অনাদায়ী থাকলে সংশ্লিষ্ট কারখানা এবং বিজিএমইএর জন্য যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়টি তারা স্বীকার করেছে। তবে এ ধরনের বেসরকারি বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভূমিকা রাখার খুব একটা সুযোগ নেই। আইনি প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছে হাইকমিশন।
মোজাইক ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যে দেখা যায়, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অধীনস্ত বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড বন্ধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ ফ্যাশন সামগ্রীর খুচরা বিক্রেতা বড় গ্রুপগুলোর একটি তারা। গ্রুপের ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে– মিলারস, রকম্যানস, ননি বি, রিভারস, কেটিস, অটোগ্রাফ, ডব্লিউ. লেন, ক্রসরোডস ও বেমে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, বিল অব লেডিং অর্থাৎ রফতানি বিল জমা দেওয়ার চার মাসের মধ্যে রফতানির অর্থ পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে। তবে পণ্য হাতে পেলেও আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশি রফতানিকারকদের অর্থ পরিশোধ করছে না মোজাইক। এখন রফতানিকারকদের কাছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় চাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ সংগঠনের সদস্য কারখানাগুলোর কাছে মোজাইকের সঙ্গে লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিল। এরপরই বিভিন্ন কারখানা তাদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা জানায়।
বিজিএমই এর এক কর্মকর্তা বলছেন, রফতানি মূল্য না পাওয়ার এরকম পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী কারখানাগুলোর পথে বসার দশা হয়। অতীতে এরকম ভারতীয় লিলিপুট এবং পিককের ঘটনায় অনেক কারখানা সর্বস্বান্ত হয়েছে। অথচ কারখানার কোনো দায় নেই। আবার কোনো কারখানার একার পক্ষে কিছু করারও সুযোগ কম। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে পদক্ষেপ নেয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই দেশের সরকারের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারে। এতে রফতানি আয় আসবে, কারখানাগুলো টিকে যাবে, শ্রমিকরাও কাজ হারাবেন না।
ক্ষতিগ্রস্ত ২৩ কারখানার মধ্যে রয়েছে- বিগ বস কর্পোরেশন, অ্যাক্টিভ কম্পোজিট মিলস, সাভার সোয়েটার্স, পদ্মা সাটেল, আরব ফ্যাশন, সুলতানা সোয়েটার্স, ওসিস ফ্যাশন, এফএনএফ ট্রেন্ড ফ্যাশন, ফ্যাব্রিকা নিট কম্পোজিট, এনআরএন নিটিং অ্যান্ড গার্মেন্টস, স্মাগ সোয়েটার্স, ভুয়ান ওয়ার্মটেক্স, ফাইন সোয়েটার্স, হেরা সোয়েটার্স, হাইড্রোক্সাইড নিটওয়্যার, মেগা ডেনিম, মেনস ফ্যাশন, অ্যাসরোটেক্স গ্রুপ, রিয়াজ নিটওয়্যারস, ইমপ্রেস নিউটেক্স কম্পোজিট টেক্সটাইল, প্রিটি সোয়েটার্স, রায়ান নিট কম্পোজিট এবং এএসটি নিটওয়্যার।