‘স্বপ্নই হবে এসিআইয়ের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান’
সাব্বির নাসির এসিআই লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসিআই লজিস্টিকের নির্বাহী পরিচালক। বুয়েট থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক সাব্বির এর আগে দেশের শীর্ষ ফার্নিচার প্রস্তুতকারক অটবি লিমিটেডে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ডেকো এক্সেসরিজে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।২০১১ সালে স্বপ্নের ক্রান্তিকালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়েছেন। বিপুল পুঁঞ্জিভুত লোকসানের ভারে ডুবুডুবু স্বপ্নের লোকসান আরও বেড়েছে তার মেয়াদকালে। তবে অন্যান্য সূচক উর্ধমুখী। এসব সূচক লোকসান কাটিয়ে উঠে প্রতিষ্ঠানটির অনেক দূরে যাওয়ার সম্ভাবনার আভাস দিচ্ছে।
সাব্বির নাসির আশা করেন, একটু সময় লাগলেও স্বপ্ন তার লোকসান কাটিয়ে উঠবে। আর এক পর্যায়ে এটিই হবে এসিআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক।
বাংলাদেশে এখন কতগুলো সুপারস্টোর রয়েছে, বিশেষ করে চেইন সুপারস্টোর। এ খাতের ব্যবসার অবস্থা কী?
সাব্বির নাসির: সুপার মার্কেট ওনার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুয়ায়ী এক হাজারের মতো স্টোর আছে। তবে এর বড় অংশই সুসংগঠিত নয়। ব্র্যান্ডিং আছে এমন সুপার স্টোরের সংখ্যা হতে পারে ১২০টি। এর মধ্যে ৪৮টিই স্বপ্নের।
বাংলাদেশে সুপার স্টোরের ধারণা তুলনামূলক নতুন, তবে তা-ও প্রায় একযুগ হয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে সম্ভাবনার কতটুকু কাছে পৌঁছাতে পেরেছে এ খাতটি?
সাব্বির নাসির: আমার মনে হয় শুরুটা একরকম হয়েছে সুপার মার্কেট ইন্ডাস্ট্রিজের। ১৯৯৮-৯৯ দিকে। ওই সময় আগোরার হাত ধরে যাত্রা শুরু এ খাতের। ওই সময়ের প্রেক্ষাপট একরকম ছিল। আর আমরা যে সময় স্বপ্নের শুরু করি তার প্রেক্ষাপট অন্য রকম। ২০১২ সালের পর থেকে স্বপ্ন মার্কেট লিডার। এটা টার্নওভারের দিক থেকে। এই জায়গাটি এই ইন্ডাস্ট্রিজে আরেকটি মাত্রা যুগ করেছে।
শুরুর দিকে কিন্তু একটা, দুইটা স্টোর ছিল। এক সময় এই স্টোরগুলো ছিল উচ্চবিত্ত লোকদের জন্য। আমরা সবার জন্য স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছি। এর ফলে কিন্তু কাঁচাবাজার থেকে একটা বড় অংশ সুপার মার্কেটে আসছে। প্রতি দিন স্বপ্নে ২৫ হাজার মানুষ বাজার করতে ঢুকে। বাকী প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ১ লাখের মতো মানুষ সুপারস্টোরে কেনাকাটা করতে আসে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ক্রেতা এ সুপারশপগুলোতে কেটাকাটা করছে। বড় ব্যাপার হচ্ছে প্রতিবছরই ক্রেতার পদচারণা বাড়ছে। গত বছর স্বপ্নে ক্রেতার আনাগোনা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদেরও বাড়ছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার অন্যদের কিছুটা কম।
আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু এখনও সনাতনী ধারার বাজার করতে অভ্যস্ত।তারা দর-দাম করতে পছন্দ করেন। অনেকগুলো দোকান দেখে পণ্য পছন্দ করেন। এ মানসিকতার পরিবর্তনে আপনাদের কোনো বিশেষ উদ্যোগ আছে কি?
সাব্বির নাসির: দুই কারণে মানুষ দর-দাম করে পণ্য কেনেন। একটি হলো সময়ের সঙ্গে জেতার আনন্দ। আরেকটা হচ্ছে ঠকে যাওয়ার ভয়। সুপার মার্কেটে পণ্যের দর নির্ধারিত থাকায় ঠকে যাওয়া ভয় নেই। স্বপ্নের কিন্তু বাজারদর মনিটরিং সেল রয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে আমাদের কাছে পণ্যের দরের তথ্য আসে। সেই অনুযাযী আমরা পণ্যের দর ঠিক করে থাকি। এর মাধ্যমে তাদের ভয় দূর হয়েছে বলে আমি মনে করি।
একই নগরজীবনের মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ আর কষ্ট করে বাজারের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে চায় না। বিশেষকরে এখন বহু মহিলা বাজার করছে। তারা এতো ভিড়ের মধ্যে আসতে চায় না। তাই আমার মনে হয় মানুষের এই ব্যস্ততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সুপারমার্কেটগুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আমরা প্রচুর পরিমাণে প্রমোশন দিয়ে থাকি। যখন একটা ক্রেতা দেখছেন গরুর মাংসের দর কম, চাল ও মাছের দর কম, তখন তিনি আনন্দ বোধ করতে থাকেন। এতে তারা জেতার আনন্দ লাভ করে।
অনেক ক্রেতার কিন্তু অভিযোগ আছে, সুপার স্টোরগুলোতে টাটকা জিনিস, বিশেষ করে ফ্রেশ শাকসব্জি পাওয়া যায় না।আবার অন্যান্য পণ্যের মানের ক্ষেত্রেও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দামও বেশি। এমন অবস্থায় তারা সুপারস্টোরে কেনাকাটা করতে আসবেন কেন?
সাব্বির নাসির: অভিযোটি সত্য। অনেক সময় ক্রেতারা মাছ কিংবা ফল নিয়ে যাওয়ার পরে এসে বলছে এটাতো পঁচা। এক্ষেত্রে আমি বলি, এটাতো ভালো। আমিতো ফরমালিন দেই না। ফরমালিন দিলেতো কোনোভাবেই পঁচবে না।
আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে পণ্যের ফ্রেসনেসটাকে আরও সজিব রাখা যায়। এর জন্য আমরা বাইরে থেকে কিছু মেশিন আমদানি করার চেষ্টা করছি। হয়তো সামনে আরও ভালো কিছু ক্রেতাদের দিতে পারবো।
আমাদের দেশে খুবই পুরনো অভিযোগ, ফসলের উৎপাদকরা ন্যায্য মূল্য পান না। তাদের পণ্যে লাভবান হন মধ্যস্বত্তভোগীরা। সুপারস্টোরগুলো কি এ অবস্থার পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
সাব্বির নাসির: যে অভিযোগ কৃষক ভাইরা করেন সেগুলো সত্য। তাদেরকে ন্যয্যমূল্য দেওয়ার জন্য কাজ করছে স্বপ্ন। আমরা কৃষকদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে আলোচনা শুরু করছি। ১০০ ভাগ করতে পারোব কি না জানিনা। তবে তাদের অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য কাজ করছি। আগামী ৫ বছর নাগাদ এটি করা যাবে বলে আমরা মনে করি। আবার এটিও বলতে চাই শুধু তাদের উরপ ভরষা করে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান চালানোটাও কঠিন। তাই আমরা কৃষক ও ডিলার উভয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করদতে চাই।
এবার স্বপ্নের প্রসঙ্গে আসি। যতদূর জানি, দেশের চেইন সুপারস্টোরগুলোর মধ্যে স্বপ্নের আউটলেটের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আপনাদের আর কি বিশেষত্ব আছে? কেনো ক্রেতারা দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য স্বপ্নকে বেছে নেবেন?
সাব্বির নাসির: হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। স্বপ্ন এখন সবচেয়ে বড় চেইন সুপারস্টোর। আমাদের বর্তমানে ৪৮টি আউটলেট আছে। সামনে হয়তো আরও বাড়তে পারে। আমাদের বিশেষত্ব হলো আমরা স্বপ্নটাকে সবার জন্য সমান করে দিয়েছি। এবং আমরা সব কিছুর দাম নির্ধারণ করি প্রতি দিনের বাজার দর দেখে। স্বপ্নে বাজার করে কেউ ঠকবে না।
অনেক সুপার স্টোর নিজে অথবা একই মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এখন শাকসব্জিসহ অনেক পণ্য উৎপাদন করছে। স্বপ্নের অবস্থাটা কি?
সাব্বির নাসির: এসিআইয়ের স্বপ্ন গড়ার মূল উদ্দেশ্য চারা থেকে ক্রেতাদের হাত অর্থাৎ শুরু থেকে একদম ক্রেতাদের মাঝে পৌছে দেওয়া। সেই জায়গা থেকে আমরা কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে কৃষক ও জেলেদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যে কারণে আমরা অনেক কম রেটে মার্কেটে দিতে পারছি।
সামনে ঈদ। ঈদ উপলক্ষ্যে স্বপ্নে কি ধরনের বিশেষ আয়োজন থাকতে পারে?
সাব্বির নাসির: আমাদের স্বপ্নের দুইটি বিজনেস কোর ও লাইফ স্টাইল। রমজান কেন্দ্রীক আমাদের ব্যবসা হবে ২৫ রমজান পর্যন্ত। এর পর থেকে শুরু হবে আমাদের ঈদ কেন্দ্রীক ব্যবসা। রমজানের জন্য বিশেষ আয়োজনেই মধ্যে আছে ছোলা, খেজুর, শশা, লেবু, মুরগি, গরুর সহ আরও অনেক জিনিস। ২৫ রমজানের পর থেকে আমাদের ঈদের জন্য বিশেষ কিছু থাকবে।
সেখানে ছোট-বড় সবার জন্যই আয়োজন থাকবে।
স্বপ্ন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এসিআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান।এ কারণে এ নিয়ে মানুষের কৌতুহল অনেক। অনেকে স্বপ্নকে এসিআইয়ের শ্বেতহস্তি মনে করেন।গত একদশকের মধ্যে গত বছর প্রথমবারের মতো এসিআই লোকসান দিয়েছে। সেটি হয়েছে স্বপ্নের কারণে। তো এই লোকসানের কারণ কি? লোকসান কাটিয়ে উঠতে আপনাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
সাব্বির নাসির: দেখেন যে কোম্পানিগুলোর একাধিক শাখা থাকা,তাদের সব শাখা কি লাভোবান হবে, এই ধারণাটি ভূল; একই সঙ্গে সব ব্যবসা যে অনেক ভালো হবে এটা ভাবা কিন্তু ঠিক নয়। একেকটা ব্যবসা উদ্দেশ্য থাকে আলাদা। স্বপ্নের ক্ষেত্রে বলবো এটা ভবিষতের ব্যবসা। এটা নগদের ব্যবসা না। এখন থেকে প্রোফিট আসতে সময় লাগবে। এসিআইয়ের অনেক ব্যবসা রয়েছে যা বর্তমানের ব্যবসা। শুরুর দিকেই লাভ বান হওয়া যায়। আর আমাদের বিনিয়োগটা দুই দিকে করতে পারি। ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কে। আমি বলবো স্বপ্ন এখন গ্রোথ ফেজে আছে। এখন টার্নওভার প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো। আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই আমরা মাসে ১০০ কোটি টাকা টার্নওভার অতিক্রম করবো। আশা করি তাহলে লোকসানের সমস্যা সমাধান হবে। এই গ্রোথ ফেজে স্বপ্নকে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এই গ্রোথ ফেজে আপনি যদি অবচয় ব্যয়, ফাইন্যান্সিং কস্ট যদি ধরেন, পুরান লোকসানের ওপরে যদি সুদ ধরেন। তাহলে কিন্তু সে প্রোফিট করতে পারবো না। আপনাকে দেখতে হবে এর গ্রোথ ভালো আছে কি না। যদি ব্যবসাটা খারাপের দিকে যায় সেক্ষেত্রে আপনি টেসশনে পড়ে যাবেন। যদি ভালো হয় তবে একটা সময়ে আপনার লোকসানগুলো কাভার করে ফেলবে। তবে এসিআইয়ের ম্যানেজমেন্ট স্বপ্নকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।