প্রিয় পিতাকে মনে করে
আজিজ আল কায়সার টিটো
আমার প্রাণপ্রিয় পিতা, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ হাসেম ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। সাধারণ হিসেবে এমন এক বয়স যখন মানুষ পরপারে পাড়ি দিলে মনে হয় যে এক দীর্ঘ জীবন কাটানোর শেষে বুঝি এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার বেলায় আমি তবু মন খারাপ করে বসে থাকি মাত্র একটা কারণেই যে আমি জানি তিনি চলে যাওয়ার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না, একদমই না এবং তার হাতে অনেক কাজ বাকি ছিল। অন্যদিকে এটাও কথা যে তাকে দেখে তার প্রকৃত বয়স বোঝার কারো উপায় ছিল না। যে পরিমাণ হাসি-খুশি, কর্মচঞ্চল আর প্রাণশক্তিতে ভরা এক মানুষ ছিলেন তিনি, তাতে যে কারো মনে হতো, এ মানুষটা নতুন করে জীবনের আরেক ইনিংস শুরু করার ক্ষমতা রাখেন।
ব্যবসার ও শিল্পায়নের জগতে আমার বাবা রেখে গেছেন এক তুলনাহীন ঐতিহ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর যখন সবকিছু এলোমেলো, যখন পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া একটা ভস্মস্তূপের ওপর, তখনই তিনি গড়ে তুললেন পারটেক্স, যা একটা ট্রেডিং কোম্পানি থেকে অল্প সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল এক বড় ম্যানুফ্যাকচারিং করপোরেশনে। সত্যি বলতে, আমার বাবা এমএ হাসেম আর হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন তারই মতো সাহসী ও দূরদর্শী মানুষ ছিল বলেই বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর দাঁড়িয়ে গেল বেসরকারি খাতের ব্যবসা ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রটুকু।
আমার বাবার মধ্যে কী এক অন্তর্দৃষ্টি ছিল যে তিনি এক নিমিষে বুঝে ফেলতে পারতেন কোন ব্যবসা চলবে আর কোনটা চলবে না। এছাড়া আরেকটা বড় গুণ ছিল তার, কার কী সাহায্য লাগবে, কাকে কী উপকার করলে সে উঠে দাঁড়াবে, এটাও বুঝতে পারতেন তিনি। আসলে তিনি বুঝতেন, একলা দাঁড়ালে হবে না, সবাই মিলে না দাঁড়ালে শেষে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরই ক্ষতি, ব্যবসার জন্য মূল দরকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, যেটা কিনা অনেকে একসঙ্গে গড়ে না তুললে হবে না। এই যে সবাইকে নিয়ে চলা, অনেক মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে করতে নিজে দাঁড়ানো, এ ব্যাপারটা তার কাছে ছিল ব্যবসায় লাভ করার চেয়েও বড় ব্যাপার। আরেকটা বিরাট বিষয় ছিল তার স্বভাবের অংশ, ব্যবসা করতে হবে যতটা না লাভের জন্য, তার চেয়ে বেশি জনমানুষের কর্মসংস্থানের জন্য। যত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, তত নতুন লোকের চাকরি, তত একেকটা করে পরিবারের দাঁড়িয়ে যাওয়া। এমনটাই মনে করতেন তিনি। তার মূল তৃপ্তিই ছিল এটা অনুধাবন করা যে সুস্থ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান মানেই এত এত হাজার পরিবারের এত হাজার মানুষের ভালো থাকা, তাদের সন্তানেরা ভালো জায়গায় পড়া, ভালো মানুষ হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের গড়ে ওঠা। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। মানুষের উপকার করাই হওয়া উচিত যেকোনো ব্যবসার উদ্দেশ্য—এটাই ছিল তার আদর্শ এবং তিনি এ আদর্শ দিয়েই বড় করেছিলেন তার পাঁচ ছেলেকে, যাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বড়।
আমার অনেক কাছের মানুষ ছিলেন বাবা। পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, জনতা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মতো স্বনামধন্য সব প্রতিষ্ঠানের গড়ে ওঠার পেছনের অন্যতম বড় শক্তিটা তিনি হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে না ছিল কোনো অহংবোধ, না অতখানি আধুনিক যুগের ফাইন্যান্সিয়াল রেশিও মানা লাভের নেশা। বরং তার নেশা ছিল পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, স্ত্রী, সন্তান, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি, কাছের কিছু কর্মকর্তা আর কিছু প্রিয় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হেসে, কৌতুক করে, আড্ডা দিয়ে, গল্প করে এবং অবশ্যই রান্না করে, সেই রান্না দলবল বেঁধে মজা করে খেয়ে সময় কাটানো। অনেক সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সাধারণ ও সাদাসিধা সাদা মনের মানুষ, যিনি কারোর ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতেই পারতেন না।
তার শক্তির মূলে ছিল তার সৎসাহস। অন্যের হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি শান্তি খুঁজে পেতেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে তুলতে পেরে তিনি সবসময় গর্ববোধ করতেন।
পারটেক্স গ্রুপ, সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, আইডিএলসি ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে খুশি হওয়ার থেকেও তিনি বেশি আনন্দিত হতেন ও গর্ববোধ করতেন শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদান রাখার জন্য। তিনি নোয়াখালীর ওয়াসেকপুরের মাদ্রাসা, চৌমুহনীতে লিল্লাহ বোর্ডিং ও নোয়াখালীর এমএ হাসেম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশের প্রথম ও শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন একজন অন্যতম সদস্য। এছাড়া বৃহত্তর নোয়াখালীর একমাত্র মেডিকেল কলেজটি তারই অনুদানকৃত জমির ওপর নির্মিত। তিনি সবসময় ছাত্রদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপদেশ দিতেন। বাবা বিশ্বাস করতেন ছাত্ররাই পারবে শিক্ষার আলো দিয়ে দেশকে উজ্জ্বল করতে।
আমার বাবা মরহুম এমএ হাসেম ১৯৪৩ সালের ৩০ আগস্ট নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার ৫ নং আম্বরনগর ইউনিয়নের ওয়াসেকপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়স থেকেই ব্যবসার প্রতি বাবার ছিল প্রবল আগ্রহ। তাই ১৯৬২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তামাক ব্যবসার মাধ্যমে তার ব্যবসায়ী জীবন শুরু করেন। এরপর সত্তরের দশকে তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এমএ হাসেম করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সদ্য স্বাধীন দেশে যখন প্রায় সবকিছুরই ছিল স্বল্পতা, সবাই যখন ছিল দিশেহারা, তখন আমার দূরদর্শী বাবা লোহা, ইস্পাত, সিমেন্ট, চিনি, চাল, মসলা, গম, লবণ, দুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারজাত শুরু করেন। তার ব্যবসার সবচেয়ে বড় ও অনুকরণীয় দিক হচ্ছে ‘কমিটমেন্ট’। আমদানি পণ্যের ব্যবসা যেহেতু করতেন, তাই হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলেও যে দামে বিক্রির কমিটমেন্ট ছিল, সেই দামেই তিনি পণ্যটি ক্রেতাকে দিয়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেটি ধরে রেখেছিলেন। তিনি এখানেই থেমে না থেকে উৎপাদনমুখী ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন, যার মাধ্যমে হাজারো বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় এবং তার এ সিদ্ধান্তের কারণেই জন্ম হয়েছিল পারটেক্সের।
১৯৮৩ সালে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকার যখন রুগ্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে তখন অত্যন্ত সাহসিকতা দেখিয়ে এবং ঝুঁকি নিয়ে স্টার পার্টিকেল বোর্ড মিলসের ক্রয়স্বত্ব লাভ করেন আমার বাবা। তিনি সবসময় পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপারে আপসহীন ছিলেন। তাই অধিগ্রহণের পর ফ্যাক্টরিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে এর উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নত করেন। পাশাপাশি উদ্ভাবনী বিপণন কৌশলের দ্বারা ওই ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত পণ্যগুলোর চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি এ রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেন। এরপর তার উদ্যোগে একে একে অনেকগুলো ভারী শিল্প স্থাপনা ও পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন—ভোজ্যতেল, নারকেল তেল, ফার্নিচার, খাদ্য ও পানীয়, প্লাস্টিক, কাগজ, তুলা, সুতা, পাট, রিয়েল এস্টেট, টেক্সটাইল, শিপিং, এগ্রো, গার্মেন্টস, অ্যারোমেরিন লজিস্টিকস ইত্যাদি দেশ ও বিদেশে আলোর মুখ দেখে এবং এগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করে।
তিনি স্বভাবজাতভাবেই অত্যন্ত বন্ধুসুলভ ও জনগণের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাই ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-২ আসনের জনগণ তাকে ভোট দিয়ে এমপি হিসেবে নির্বাচিত করেন। তিনি কখনো পদ-পদবিকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তা করেননি। তিনি ছিলেন সব রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে। তাই রাজনৈতিক কারণে কখনই সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়নি বাবাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের বাইরেও বাবা ছিলেন একজন দানশীল ব্যক্তি ও সমাজসেবক। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে তিনি নিজ নামে ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও এতিমখানা এবং ওয়াসেকপুরের বেগমগঞ্জে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া বেগমগঞ্জ সমিতি ও বেগমগঞ্জ যুবকল্যাণ সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তার জীবনের মূল খুশিই ছিল মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমরা দেখেছি বাবা বেগমগঞ্জ ও সোনাইমুড়িতে অসংখ্য হতদরিদ্রকে থাকার ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন এবং অনেক দুস্থ পরিবারের মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সহায়তাও করেছেন। বন্যার সময় বাবা সবসময় ছুটে যেতেন নিজ এলাকায়। নিজে উপস্থিত থেকে খাদ্য ও বস্ত্র বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করতেন।
সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাবা একজন ধর্মভীরু ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি বেশকিছু মসজিদ ও মাদ্রাসা যেমন—নোয়াখালীর ওয়াসেকপুরের মসজিদ ও মাদ্রাসা, কাজীরহাটের মসজিদ, ঢাকার মিরপুরে ১৩ নম্বর মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরিতে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। এছাড়া তিনি ছিলেন গুলশান আজাদ মসজিদের আজীবন দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন।
আমার বাবা ছিলেন উদ্যোক্তা, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সরলতা ও মানবিকতার এক অনন্য প্রতীক। তিনি পরিবারের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন। ঘরে রান্না করা গরুর মাংস ও সাধারণ তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই খুব তৃপ্তি পেতেন। বাবা কখনো তার শেকড়কে ভুলে যাননি এবং এটিই ছিল তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, যা তাকে একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে সবার কাছে ভালোবাসার পাত্র করে রেখেছে।
আজিজ আল কায়সার টিটো: এমএ হাসেমের পুত্র
সূত্রঃ বণিক বার্তা