মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা শাহাদাত অদম্য মানবিকতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

মোঃ রাজু খান (ঝালকাঠি):
শাহাদাতের জন্ম ১৯৮৭ সালে, আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। বাবাকে হারিয়েছেন চার বছর বয়সে। ছোটো থেকেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে দোকানে বসেছেন। এর মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ গ্রেড পান। এরপর ভর্তি হন বরিশাল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে। পরিবারে তার আরও দুই ভাই ছিলেন। তাদের একজন হঠাৎ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় পতিত হলে শাহাদাত পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। সবাইকে বলেছিলেন, আমার ভাই মরে যাচ্ছে আর আমি পড়াশোনা করব এখানে? বাজারের আড়তে বসলেও পরিবারের কিছুটা সহযোগিতা হবে। অসুস্থ ভাইয়ের মৃত্যুর পর অপর ভাইয়ের দোকানে কর্মচারীর মতো ছিলেন শাহাদাত। এর মধ্যেও মা-বোনের খরচ চালাতেন। এক পর্যায়ে নলছিটি খাসমহল বাজার এলাকায় নর্দমার পাশে রাস্তায় আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেন। বর্ষায় পানিতে বহুবার আলু ও পেঁয়াজের ক্ষতি হয়েছে তার। বিয়ে করেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। তিন সন্তানের বাবা এখন শাহাদাত। ২০১৩ সালে থাইরয়েড ক্যানসার ধরা পরে তার। এ পর্যন্ত ভারতের চেন্নাইতে ক্যাম-থেরাপিসহ চিকিৎসা নিয়েছেন কয়েকবার। মৃত্যুকে তখনই কাছ থেকে দেখেছেন। গত দুই বছর আগে তার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর আগ থেকেই তার চালের ব্যবসা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলছে। তার মায়ের নামে একটি সেবামূলক ফাউন্ডেশন করেছেন। গত বছর রমজানে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ১০০ রেহাল (কুরআন রেখে পড়ার দ্রব্য) দিয়েছিলেন মানুষকে। এবারও প্রায় ১০০ রেহাল প্রস্তুত রেখেছেন। করোনা মহামারি থেকে মুক্তি পেতে নির্ধারিত দোয়া হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে লিফলেট ও স্টিকার মানুষকে দিয়েছেন। শাহাদাত বলেন, মৃত্যুকে অনেকবার খুব কাছ থেকেই দেখেছি। তাই আমার চাহিদা সীমিত। টাকার প্রতি আগ্রহ কম। আল্লাহ রিজিক যা রেখেছেন; তা আমি ভোগ করে যাব। শাহাদাতকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যা (বিএসএমএমইউ) প্রায়ই চিকিৎসা ফলোআপে যেতে হয়। জীবনের বাকি সময় ভালো পথে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। জীবনের গল্পগুলো বলতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলেছেন। অনুরোধ করেছেন তিনি যে, ভালো কাজগুলো করেছেন; তা যেন প্রচার না হয়। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে সাধারণ মানুষের জন্য প্রতি বস্তা চাল পাইকারি দামের চেয়েও অন্তত ৫০-৬০ টাকা কমে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী মো. শাহাদাত ফকির। তিনি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার একজন তরুণ চাল ব্যবসায়ী। আট বছর ধরে শরীরে ক্যানসার বহন করছেন তিনি। অথচ করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকেননি। মসজিদের ইমামসহ তিনজনের উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘শাবাব ফাউন্ডেশন’। করোনায় মৃতদের গোসল দেওয়াসহ দাফনের জন্য ফাউন্ডেশনে সদস্য আছেন ২৫ জন। প্রথম ধাপের ১২ জন কখনো সক্ষম না হলে পরবর্তী ১৩ জনের টিম গোসল ও দাফন দেবেন। এ পর্যন্ত ১৭ জন করোনায় মৃত মানুষের গোসল ও দাফন দিয়েছেন তারা। ফাউন্ডেশন সম্পর্কে শাহাদাত বলেন, এখানে মুফতিসহ আলেমরা আছেন। তাদের ভূমিকায় আমরা পরিচালনা করি। এটি প্রতিষ্ঠায় মসজিদের ইমামসহ আমরা তিনজন উদ্যোগ ও সব কিছুর ব্যবস্থা করলেও কৃতিত্ব সবার। কারণ মহামারির পরিস্থিতিতে মা সন্তানকে আবার সন্তান মাকে দাফন দিতে যায়নি। সে সময়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা এগিয়ে এসেছি। রমজান উপলক্ষে সাধারণ ক্রেতাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে পাইকারি দামের চেয়েও প্রতি বস্তা ৫০ থেকে ৬০ টাকা কমে চাল বিক্রি করছি। যে দামে কেনা ঠিক একই দামে বিক্রি। একপয়সাও লাভ করছি না। পুরো রমজানজুড়ে এটি অব্যাহত থাকবে। তবে যারা ব্যবসার জন্য চাল কিনবেন তাদের পাইকারি দরেই কিনতে হবে। অনেক পাইকারি ক্রেতার কাছেও কম মূল্যে দিয়ে অনুরোধ করেন সাধারণ মানুষের কাছে একটু কম লাভে বিক্রি করতে। সব ব্যবসায়ীকে তার মতো উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানান শাহাদাত। মো. শাহাদাত ফকিরের উদ্যোগ প্রশংসনীয় উল্লেখ করে নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুম্পা সিকদার বলেন, পবিত্র রমজান মাস এবং করোনার সময় শাহাদাত ফকিরের এ উদ্যোগ মানুষকে অনেক স্বস্তি দেবে। যেখানে সবাই সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেখানে তিনি কমিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেন।