উদ্যোক্তা হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
নারী সমাজ বরাবরই অবহেলিত। উচ্চতর ডিগ্রি নিলেও অধিকাংশ নারীর ঠিকানা যেন রান্নাঘর। পুরুষপ্রধান এ সমাজে ঘর থেকে বের হতে হলে বাবা, ভাই কিংবা স্বামীর অনুমতি নিতে হবে, তারপরও আছে কত বাধা-নিষেধ। দীপ্ত পদচারণায় এসব প্রতিবন্ধকতা নারীরা এখন জয় করতে শিখেছেন। এখন নারীরা পড়াশোনা করছেন, চাকরি করছেন- এমনকি স্বাধীন উদ্যোক্তাও হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, যেসব নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করছেন, তারা ভালো করছেন।
২০২০ সালে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে পরিবারের ওপর নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। তবে করোনার এ মহামারির মধ্যে নারীকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও প্রত্যয়ও দেখেছি। টিকে থাকার লড়াইয়ে সফলতার সঙ্গেই অনেক নারী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। কিন্তু সবাই শুধু সফলতার গল্পটাই শোনে। এর পেছনের কষ্টটা কিন্তু কেউ দেখে না।
আমরা এমন অনেক নারীকে দেখেছি, যে কিনা পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন করোনার সময়ে, অথচ তাদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ছিল না কোনো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। সেই জায়গা থেকে একজন নারীর ঘুরে দাঁড়ানোটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তারা তা করে দেখিয়েছেন। তাদের ছিল না কোনো পুঁজি, ছিল না কোনো বিজনেস প্ল্যান; কিন্তু গত প্রায় দুই বছর থেকে উদ্যোগটা ধরে রেখে নিজের সংসার চালাচ্ছেন। আমাদের নারীরা কঠিন সময়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আমরা শুধু রান্নাবান্নাই পারি তা নয়, প্রয়োজনে অর্থনৈতিক হালও ধরতে পারি।
করোনার সময় থেকে নতুন-পুরোনো মিলে চার লক্ষাধিক নারী উদ্যোক্তা যুক্ত আছেন আমাদের উই ফোরামে (ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের গ্রুপ)। করোনাকালীন বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সরকারের নানা সুবিধা ও প্রণোদনা পেলেও আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই পাননি সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ। কারণ, তাদের বেশির ভাগেরই নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্স, নেই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কিন্তু তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ছোট ছোট এই নারী উদ্যোক্তা যেন সফল হতে পারেন, এ জন্য তাদের সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক ও পলিসিগত সহযোগিতা দেওয়া জরুরি।
আমাদের এই নারীদের উন্নয়নের জন্য কিছু প্রস্তাবনা আমার আছে। প্রথমেই হলো তাদের সবাইকে স্কিল ডেভেলপমেন্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ফ্রি ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা যেন হয় উন্নতমানের প্রশিক্ষণ। দ্বিতীয়ত, এসব নারী উদ্যোক্তাকে প্রথমেই ঋণ কিংবা প্রণোদনা প্যাকেজ নয়, তাদের জন্য ছোট ছোট এককালীন অনুদান দিতে হবে। যেটার মাধ্যমে তারা ছোট আকারে তাদের উদ্যোগকে কাজে লাগাতে পারবে এবং সেটিকে মনিটরিং ও মেন্টরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং পাশাপাশি তাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ভেতর নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে ফেসবুকের কোনো সমস্যা হলেও যেন আমাদের নারীদের উদ্যোগটি বন্ধ না হয়ে যায়।
পাশাপাশি আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত কিছু আয়োজন করতে পারলে বেশ ভালো হয়, কারণ তাতে করে আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য সামনাসামনি সবাই দেখতে পারবে এবং এতে করে নেটওয়ার্কিংয়ের একটা পল্গ্যাটফর্মও তৈরি হয়। পণ্য প্রদর্শনী বা মেলা যেটাই বলি না কেন, সেটা করতে হবে একদম স্বল্পমূল্যে, যাতে করে আমাদের উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ না পড়ে। খুব ভালো হয় যদি বছরে তিনটি মেলা করা হয়, আর তার ভেতর একটি সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেওয়া হয়।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের এসব নবীন উদ্যোক্তা আবার রপ্তানিও করছেন। তবে রপ্তানি করার যে নিয়ম-নীতি আছে, যে ধরনের ডকুমেন্ট তৈরি করতে হয়, তার কিছুই তারা জানেন না। আবার পণ্য দেশের বাইরে কুরিয়ার করতে গেলে বিশাল বড় একটা খরচ সেখানে হয়ে যায়। সেই খরচ কমিয়ে আনতে পারে আমাদের সরকার যদি পোস্টাল সার্ভিসকে ডিজিটাল করতে পারে। সঙ্গে রপ্তানি বিষয়ে যে ধরনের ১৫ থেকে ২০টি ডকুমেন্ট রেডি করতে হয়, সেই জায়গাটি যদি আরও সহজ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে আমাদের নারীদের একটি বড় ভূমিকা থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
উই থেকে আমরা নারীদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট, প্রোডাক্ট প্যাকেজিং, এক্সপোর্ট সম্পর্কিত সবকিছু সাপোর্ট দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা এরই মধ্যে দেশের বাইরে দুটি আন্তর্জাতিক চ্যাপ্টার ওপেন করেছি। নতুন বছরে এ সংখ্যাটি বাড়বে। তবে সব মিলিয়ে বলব ২০২১ সাল ছিল আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের বছর। টিকে থাকার বছর। ২০২২ সাল হবে তাদের উদ্যোগের গ্রোথ লেভেল বাড়ানোর সময়।