South east bank ad

ব্যাংক খাতে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ

 প্রকাশ: ১৩ অগাস্ট ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   ব্যাংক

ব্যাংক খাতে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়।

সোমবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এসব তথ্য জানান। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, যার ফলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ করার জন্য সিআইডি ৭৯ বার সময় নিয়েছে। নতুন সময় ৪ সেপ্টেম্বর। ভবিষ্যতে এমন দেখতে চাই না। আমরা চাই ওই তদন্ত প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।

আর্থিক খাতের অন্যতম সমস্যা মামলা জটিলতা। মামলার কারণে বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে আছে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আর্থিক আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২ হাজার ৫০০টি। টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে আর্থিক কেলেঙ্কারি খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণায় দেখিয়েছিলাম ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে, যার পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ বাতিল করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ অর্থাৎ এফআইডি রয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে তার কার্যক্রম করতে পারে না। এটা সৃষ্টি করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রভাবিত করা।

তিনি বলেন, অন্যায়ভাবে ঋণ কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত যেগুলো নেওয়া হয়েছে, তার একটি তদন্ত হওয়া উচিত। আমাদের সুপারিশ এফআইডি বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এই বিভাগের কোনো প্রয়োজন নেই।

ব্যাংক একীভূত করার ব্যাপারে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকগুলো একীভূত করার পূর্বশর্ত হলো অডিট করে ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখা। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ক্যাটাগরি ঠিক করে দিতে হবে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুঁজি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও দেখা প্রয়োজন।

ব্যাংকিং খাতে এখনই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ জানিয়ে তিনি বলেন, তা হলে অর্থনীতির বিরাট জায়গা আমরা উন্নত করতে পারব। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করা, নিয়ম-নীতি না মেনে বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া এ খাতের মূল সমস্যা।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। বোর্ডের সদস্য নির্বাচন করা, লোন স্যাংশন করার প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পরিপালনে দুর্বলতা রয়েছে। স্বাধীনতা খর্ব হতে হতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোপুরি স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে। এখানে প্রশাসনের দ্বৈততা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, এর কোনো প্রয়োজন নেই। বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী শ্রেণি তৈরি করার জন্য ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া হয়। এসব ব্যাংকের কোনো সক্ষমতা নেই। সেগুলোকে আবার সরকারি অর্থে রি-ক্যাপিটালাইজেশন করা হয়। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মধ্যে তারা একটি অলিগার্ক তৈরি করে রেখেছে। তারা কয়েকজন মিলে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারা নিয়ন্ত্রণ করছে, নীতিমালা তৈরি করছে। অনেক খেলাপি ঋণের মামলা জমে গেছে। ব্যাংক খাত দুর্বল হচ্ছে, কারণ ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্ট পরিবর্তন করা হয়। আইনের ফাঁকফোকরে অনেক ঋণখেলাপি বের হয়ে যায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্ব যারা পালন করেছেন অর্থাৎ গত ১৫ বছরে গভর্নর যারা ছিলেন, তারা যে সব নীতিমালা নিয়েছেন, ওইগুলো ব্যাংকিং নর্মসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া জন্য অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। যার ফলে বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিটি কেইস তদন্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক বিভাগ বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক বিভাগ অর্থাৎ এফআইডি রয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে তার কাজ করতে পারে না। এটা সৃষ্টি করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রভাবিত করা। আমরা মনে করি, অন্যায়ভাবে ঋণ কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত যেগুলো নেওয়া হয়েছে, তার তদন্ত উচিত। আমাদের সুপারিশ, এফআইডি বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এই বিভাগের কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে আমাদের নৈতিক সমর্থন ছিল। ছাত্রদের মুক্তির মিছিলে আমরা ছিলাম। যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের কাছে আমাদের এগুলো কিছুই না। আর্থিক খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরি করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জগুলো আর্থিক খাতেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অসুস্থ, বিকলাঙ্গ। একইভাবে বীমা খাতও অগ্রহণযোগ্য অবস্থায় আছে। আর্থিক খাতে সুশাসনের জন্য ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিকভিত্তিক খাতগুলো বন্ধ করতে হবে।

ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করতে ব্যাংক কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। আরও বলেছে, ব্যাংক খাতে দ্বৈত প্রশাসন চলছে। বন্ধ করে দেওয়া উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ ছাড়া কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার সংস্কৃতিও বন্ধ করতে হবে।

সিপিডি বলেছে, চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের হাতেই সাতটি ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। একসময় ইসলামী ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। দখলের পর তা-ও মুমূর্ষু হয়ে গেছে। এ ছাড়া একক গ্রাহকের জন্য ঋণসীমা নীতি লঙ্ঘন করে জনতা ব্যাংক এননট্যাক্স গ্রুপকে দিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এভাবে একক গোষ্ঠী যদি এত বেশি পায়, অন্য গ্রাহকরা কী পাবে।

BBS cable ad

ব্যাংক এর আরও খবর: