সংস্কৃতিতে তাদের অবদান
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর দেশের ২৪ বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক দিতে যাচ্ছে সরকার। গতকাল (০৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়। সংস্কৃতি অঙ্গনে অবদান রাখায় এবার শিল্পকলা বিভাগে একুশে পদক পাচ্ছেন ৭ জন। অভিনয়ের জন্য পদক পাচ্ছেন মাসুম আজিজ, খালেদ খান (মরণোত্তর) ও আফজাল হোসেন। নৃত্যে অবদান রাখায় পদক পাচ্ছেন জিনাত বরকতউল্লাহ। সংগীতের জন্য পদক পাচ্ছেন নজরুল ইসলাম বাবু (মরণোত্তর), ইকবাল আহমেদ ও মাহমুদুর রহমান বেণু। লিখেছেন- তারেক আনন্দ ও জাহিদ ভূঁইয়া
মাহমুদুর রহমান বেণু
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ হয়ে ওঠে অনিবার্য। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, মুক্তাঞ্চল ও শরণার্থী শিবিরে মুক্তিবাহিনীর মনোবল জোগাতে যেসব শিল্পী সংগ্রাম ও স্বাধীনতার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও শরণার্থী শিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন মাহমুদুর রহমান বেণু তাদের অন্যতম। কলকাতার লেনিন রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে একদল শিল্পী মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। বেণু ছিলেন সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সেক্রেটারি।
১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের চিত্র ধারণ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন বাংলাদেশে এসে যুক্ত হয়েছিলেন বেণু ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ সম্পর্কে বেণুর চাচাতো ভাই, ১৯৯০ সালে বেণুর মাধ্যমে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লিয়ার লেভিন সম্পর্কে এবং লেভিনের সেই ভিডিওচিত্রগুলো কিনে নেন। পরে লিয়ার লেভিনের ভিডিও ও বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত ভিডিও চিত্রের ওপর ভিত্তি করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তৈরি করেছিলেন ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটি।
ইকবাল আহমেদ
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান গণসংগীতে বয়ে আনে নতুন জোয়ার যেখানে ক্রান্তি-উদীচীর পাশাপাশি ছায়ানট ও সংস্কৃতি সংসদের ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। গণঅভ্যুত্থান গণসংগীতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে, দেখা মেলে নতুন গানের, নতুন শিল্পীর; এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইকবাল আহমেদ। যিনি স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েছিলেন; পাকিস্তানিদের অমানবিক নির্যাতনের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, জাহিদুর রহিমের কাছে রবীন্দ্রসংগীত ও শেখ লুৎফর রহমানের কাছে গণসংগীতের দীক্ষা নিয়েছেন ইকবাল। ১৯৭০ সালে এইচএমভির ব্যানারে প্রকাশিত ইকবাল আহমেদের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘জানি জানি গো’ টপচার্টে উঠে এসেছিল। তিনি দুই মেয়েসহ সপরিবারে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করছেন; বছর তিনেক আগে একবার ঢাকায় এসে জাতীয় জাদুঘরে গান পরিবেশন করেছিলেন।
খালেদ খান
১৯৭৫ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চনাটকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। মঞ্চে তার অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘রক্তকরবী’। ‘ঈর্ষা’ নাটকে অভিনয়ের জন্য কলকাতায়ও তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। খালেদ খান নির্দেশিত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘মুক্তধারা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘কালসন্ধ্যা’, ‘স্বপ্নবাজ রূপবতী’, ‘মাস্টার বিল্ডার’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ প্রভৃতি। ১৯৮১ সালে বিটিভির ‘সিঁড়িঘর’ নাটক দিয়ে টিভিতে অভিষেক তার। এর পর অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন। নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘রূপনগর’, ‘মফস্বল সংবাদ’, ‘ওথেলো এবং ওথেলো’, ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’ প্রভৃতি। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি নিয়ে খালেদ খান ছিলেন বিরল অভিনেতা। তাকে অভিনয়শিল্পেরও যুবরাজ বলা হতো। দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন সমস্যায় ভুগে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যান তিনি।
মাসুম আজিজ
মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠ অভিনেতা মাসুম আজিজ। চিত্রনাট্যকার ও নাট্য নির্মাতা হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। এর পর ১৯৮৫ সালে অভিনয় করেন প্রথম টিভি নাটকে। মাসুম আজিজের রচনা ও নির্দেশনায় কিছুদিন আগেই মঞ্চে এসেছে নাটক ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ৪০০-এর অধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। প্রশংসা পেয়েছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও।
মাসুম আজিজ বলেন, ‘খবরটি শোনার পর থেকে শুধু কান্না আসছে। আমার স্ট্রাগল তো কারও অজানা নয়। জীবনের সব সুখ আর আনন্দ বাদ দিয়ে থিয়েটার করেছি, নাটক করেছি। অভিনয়ে বিরতি দেইনি। এ প্রাপ্তি বোধহয় তারই ফল। সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
নজরুল ইসলাম বাবু
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা’ কিংবা ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’- অসাধারণ গানগুলোর শিল্পীর নাম অনেকেই জানলেও এ প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ জানেন না এর স্রষ্টার নাম। তিনি নজরুল ইসলাম বাবু। বছরের পর বছর ধরে তার লেখা দেশের গান গাওয়া হয়। আধুনিক, চলচ্চিত্রের গানগুলোও মানুষের মুখে মুখে। এ মানুষটিকে রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের জন্য অনেক আগেই দাবি ছিল। অবশেষে এবার পেলেন।
প্রয়াত এ গীতিকারের স্ত্রী শাহীন আক্তার বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) আমরা জানতে পারি। ভাবতে ভালো লাগছে যে, অনেক বছর পর হলেও অবশেষে তিনি স্বীকৃতি পেলেন। দিনটি আমাদের জন্য বিশেষ স্মরণীয়। তিনি থাকলে হয়তো আরও বেশি খুশি হতেন।’
জিনাত বরকতউল্লাহ
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় নৃত্য চর্চার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জিনাত বরকতউল্লাহ। তার নৃত্যযাত্রা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে। নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের কাছে প্রথম শিক্ষা নেন। ঢাকায় তিনি বুলবুল ললিতকলা কেন্দ্র ও বাফায় নাচ শিখেছেন। ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরী- উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের তিন ধারায় তালিম নিলেও জিনাত বরকতউল্লাহ পরে লোকনৃত্যকেই জীবনের পাথেয় করে নেন। ১৯৮০ সালে তিনি বিটিভির নাটক ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন। পরে আলোচিত ধারাবাহিক ‘ঘরে বাইরে’, ‘অস্থায়ী নিবাস’, ‘বড় বাড়ি’, ‘কথা বলা ময়না’সহ বেশ কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় করেন।
আফজাল হোসেন
অভিনেতা, নির্মাতা, লেখক ও চিত্রশিল্পী- অনেক গুণ আফজাল হোসেনের। বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয় দিয়ে দর্শকহৃদয় জয় করেছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে তিনি থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হন। অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেছেন। আশির দশকে বাংলাদেশের নাটকে সুবর্ণা-আফজাল জুটি বিশেষ দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। ‘দুই জীবন’, ‘নতুন বউ’ ও ‘পালাবি কোথায়’-এর মতো সিনেমায় আফজাল হোসেনকে দেখা গেছে। ১৯৮৪ সালে তিনি বিজ্ঞাপন নির্মাণে যুক্ত হন। এ ছাড়া দেখা গেছে নাটক পরিচালনায়ও। লেখালেখিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কিছু বইও।