প্রত্যাহার হচ্ছে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এজিএম
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
দেড় বছর পর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স থেকে প্রশাসক প্রত্যাহার হচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই এই কোম্পানি থেকে প্রশাসক প্রত্যাহার করা হতে পারে। প্রশাসক প্রত্যাহারের মাধ্যমে কোম্পানিটির পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন সমঝোতার মাধ্যমে গঠিত নতুন পর্ষদ। এই পর্ষদের অধীনেই আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০১৯ সালের সমাপ্ত বছরের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা হবে।
এরইমধ্যে এ সংক্রান্ত আদালতের আদেশের সার্টিফায়েড কপি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে পৌঁছানো হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইডিআরএ-কে চিঠি দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা রোববার জানান, আদালতের আদেশের একটি কপি আমরা পেয়েছি। এর আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আজই আমরা আইডিআরএ-কে চিঠি দেবো।
অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একই সঙ্গে আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে গত দেড় বছরে ৩ দফায় প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে আছেন আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য কুদ্দুস খান।
অবশ্য প্রশাসক নিয়োগের আগেই আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার অভিযোগ তোলে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয়- আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছে।
দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান। ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ।
ডেল্টা লাইফে প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা পরে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়ান। ডেল্টা লাইফে প্রশাসক থাকা অবস্থায় কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে মাস্ক কেনার অভিযোগে তাকে কারাগারেও যেতে হয়।
আর ডেল্টা লাইফের নিয়ে জড়ানো বিতর্কের জেরে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে হয়েছে এম মোশাররফ হোসেনকে। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল আইডিআরএ সদস্য (লাইফ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোশাররফকে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৩ বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে হিসাবে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই চলতি বছরের ১৫ জুন তিনি পদত্যাগ করেন।
মোশাররফ পদত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনই আইডিআরএ’র নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারীকে নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর জুলাই মাসে আইডিআরএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সমাঝোতার মধ্য দিয়ে প্রশাসক প্রত্যাহার ও নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
ওই বৈঠকে আইডিআরএ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও ডেল্টা লাইফের সাসপেন্ডেড পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও নতুন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনসহ কোম্পানি পরিচালনায় ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে মামলা থাকায় ডেল্টা লাইফের প্রশাসক প্রত্যাহারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের সার্টিফায়েড কপির প্রয়োজন পড়ে। যে কারণে জুলাইতে সমঝোতার মাধ্যমে প্রশাসক প্রত্যাহার ও নতুন পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। অবশ্য এখন আদালতের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ায় এ সংক্রান্ত সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেছে। এখন আইডিআরএ থেকে নির্দেশনা দিয়েই প্রশাসক প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই ডেল্টা লাইফের প্রশাসক প্রত্যাহার সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচারক ও মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতার বলেন, আদালতের সার্টিফায়েড কপি আমরা পেয়েছি। আমরা খুব দ্রুত প্রশাসক প্রত্যাহার এবং নতুন পর্ষদের কাছে ডেল্টা লাইফের দায়িত্ব হস্তান্তর করবো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেল্টা লাইফের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে হাফিজ আহমেদ মজুমদার এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ড. মো. জুনায়েদ শফিক দায়িত্ব পাবেন। পরিচালনা পর্ষদে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পর্যবেক্ষক হিসেবে মন্ত্রণালয়ের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম-সচিবের নিম্নে নয়) থাকবেন।
এছাড়া পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন ডেল্টা লাইফের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান, ডেল্টা লাইফের সাসপেন্ডেড পরিচালনা পর্ষদে থাকা সুরাইয়া রহমান ও জেয়াদ রহমান। এদের পাশাপাশি সাকিব আজিজ চৌধুরী, চাকলাদার রেজানুল আলম এবং সাকিব আজাদ কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন।
নতুন পরিচালনা পর্ষদ সব আইন পরিপালন করে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কোম্পানির আর্থিক বিবরণী সম্পর্কিত তথ্য উদঘাটনে নতুন করে অডিট ফার্মের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পাদন করবে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ আগামী বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
শিগগির বিমা আইন ও অন্যান্য আরোপিত বিধি-নিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে একজন দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য মুখ নিবাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করবে নতুন পর্ষদ। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের মামলাগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে সহায়তা করবে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি মাসে কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করবে।
ডেল্টা লাইফের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০১৯ সালের এজিএম করার বিষয়ে আদালতের রায় রয়েছে। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই এজিএম অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৯ সালের সবকিছুই তৈরি আছে। এছাড়া ২০২০ এবং ২০২১ সালের এজিএম বাকি রয়েছে। এই দুই বছরের এজিএমও দ্রুত সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। যদি সম্ভব হয় তিন বছরের এজিএম ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে করার চেষ্টা করা হবে। আর যদি সেটা না হয় তাহলে ২০১৯ সালের এজিএম হয়ে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে পরবর্তী দুই বছরের (২০২০, ২০২১) এজিএম সম্পন্ন করা হবে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, এজিএম না হওয়ার কারণে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের পলিসি বোনাস পাননি পলিসিহোল্ডাররা। আর শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হয়েছেন লভ্যাংশ পাওয়া থেকে। ২০১৯ সালের এজিএম সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলিসিহোল্ডার এবং শেয়ারহোল্ডাররা তাদের জন্য ঘোষিত লভ্যাংশ পাবেন। তবে যেসব পলিসিহোল্ডাররা পলিসির মেয়াদ শেষে এরইমধ্যে টাকা তুলে নিয়েছেন, তারা এই লভ্যাংশ পাবেন কি না সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশ্য যাদের পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে, কিন্তু এখনো দাবির টাকা তুলে নেননি, তারা যে হারে পলিসি বোনাস ঘোষণা করা হবে, সেই হারে লভ্যাংশ বা মুনাফা পাবেন।
২০ কোটি টাকা ব্যয়ের দায়ভার কে নেবে?
এদিকে আইডিআরএ থেকে ডেল্টা
লাইফে প্রশাসক নিয়োগের কারণে গত দেড় বছরে বিভিন্ন খাতে কোম্পানিটির প্রায়
২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। এই ২০ কোটি টাকার প্রকৃত মালিক
কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা। অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে
কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা তাদের পাওনা সুবিধা থেকে বঞ্চিত
হবেন।
কী হবে ৫ কর্মকর্তার?
ডেল্টা লাইফে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর ইভিপি মিল্টন ব্যাপারী, মো. আব্দুল আউয়াল ও পল্লব ভৌমিক এই তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া আনোয়ারুল হকের ডিএমডি পদে পদোন্নতি স্থগিত করা হয়। আর ইভিপি মো. আসাদুজ্জামান মল্লিকের বদলি স্থগিত করা হয়।
পরবর্তীসময়ে উচ্চ আদালত ডেল্টা লাইফে প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিলে, চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি ডেল্টা লাইফের অফিস আদেশে এসব কর্মকর্তার সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার এবং স্থগিত পদোন্নতি পুনর্বহাল করা হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তবে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিত্রে ২৪ জানুয়ারি ডেল্টা লাইফের প্রশাসক কুদ্দুস খান এক অফিস আদেশে ৬ জানুয়ারি ও তার পরবর্তী সময়ের সব বদলির আদেশ বাতিল এবং পদায়ন ও পদোন্নতির সব আদেশ স্থগিত করেন। ফলে ডেল্টা লাইফে এই পাঁচ কর্মকর্তার আর ফেরা হয়নি। এখন প্রশাসক বিদায় নিয়ে, নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিলে এই পাঁচ কর্মকর্তার কী হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে ডেল্টা লাইফের একটি সূত্র জানিয়েছে, কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও পদোন্নতি স্থগিত নিয়ে আইনি মতামত নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, কর্মকর্তাদের যেভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছে তা অবৈধ। এখন প্রশাসক প্রত্যাহার হওয়ার মাধ্যমে নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে এই কর্মকর্তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।