বদলে যাওয়া ভূমি অফিস

মোহাম্মদপুর সার্কেল ভূমি অফিসে ঢুকতেই চোখে পড়বে ‘সেবা সহজীকরণ বোর্ড’ লেখা ইট দিয়ে বাঁধানো সাদা রঙের বোর্ডটি। তাতে কর্মীদের ছবি দিয়ে কার কী দায়িত্ব, তা লিখে রাখা হয়েছে। নামের পাশে কর্মীদের মুঠোফোন নম্বরও দেওয়া আছে। জমিজমার ঝামেলা নিয়ে যাঁরা এই কার্যালয়ে আসেন, তাঁরা যাতে দালালের হাতে না পড়েন, সে জন্য এই ব্যবস্থা।
মিরপুর ১৩ নম্বরের বাইশটেকি এলাকার একতলা কার্যালয়টি ছিমছাম করে সাজানো। হঠাৎ করে কেউ এলে হকচকিয়েও যেতে পারেন। ভাববেন, ভুল জায়গায় আসেননি তো। দেয়ালে বড় বড় করে লেখা—সহজ সেবার প্রথম ধাপ—এসি ল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করুন। দ্বিতীয় ধাপে আছে—এসি ল্যান্ড আপনাকে পরামর্শ দেবেন, কী করতে হবে। আর তৃতীয় ধাপেও কাজ শেষে এসি ল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলে সর্বশেষ অবস্থা জানান। দেয়ালে সিটিজেন চার্টার হালনাগাদ করে টাঙানো।
কয়েক বছর আগেও এ কার্যালয়ের চেহারা ছিল অন্য রকম। অন্য সব সরকারি কার্যালয়ে যেমন থাকে। কিন্তু ২০১২ সালে কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে তোফাজ্জল হোসেন যোগ দেওয়ার পরই বদলে যায় সবকিছু। এখন প্রতিটি কাজের জন্য সার্ভিস চার্জ কত, তা বড় করে লিখে রাখা আছে, কারও কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।
ওই কার্যালয়ে কথা হলো রিহাজুল ইসলাম মিয়ার সঙ্গে। তিনি একজন সাংসদের হয়ে এখানে কাজ করতে এসেছেন। তিনি জানালেন, সাংসদের কাজ বলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়নি। সাংসদের কাছ থেকে লিখিত আনার পরই তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে।
তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার জমি, তিনি নিজে যদি আসেন, তাহলে দুর্নীতি অনেক কমে যায়। সেবাগ্রহীতা এলে তাঁকে প্রথমেই বলি—বসেন, আপনাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। এ কথা শুনে তাঁরা শক্তি পান।’
কেরানীগঞ্জে দারোয়ানের কাজ করা শামসুল হক ব্যাপারীকে পাওয়া গেল তোফাজ্জল হোসেনের রুমে। শামসুল হকের মায়ের নামে থাকা কিছু জায়গা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি কিছু বুঝতে পারেন না বলে দালাল ধরেছিলেন। দালালকে গেটের বাইরে রেখে তোফাজ্জল হোসেন শামসুল হকের সঙ্গে কথা বলেন।
শামসুল হক বললেন, ‘এর আগে কত জায়গায় ঘুরছি, টাকা খরচ করছি, কিন্তু এরম করে কেউ বহায় নাই।’
তোফাজ্জল হোসেন কার্যালয়টিকে সিটিটিভির আওতায় এনেছেন। দৈনিক এক শ থেকে দেড় শ জন বিভিন্ন সেবা নিতে আসেন এ কার্যালয়ে। বসার জন্য চেয়ার রাখা জায়গাটিতেই রাজস্ব আদালত ও গণশুনানি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেবাকুঞ্জ মাটি ও মানুষ’।
তোফাজ্জল হোসেন বললেন, ‘বসার চেয়ার, গণশুনানি কেন্দ্রসহ অনেক কিছুই সরকারের বাজেট থেকে করা হয়নি। সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট জমি যাচাইয়ের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি সফটওয়্যার তৈরি করিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৫০০ নামজারি মোকদ্দমার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তাঁকে। ঘণ্টায় ২০০ থেকে ৩০০ নথির সরকারি স্বার্থ এ সফটওয়্যার দিয়ে যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে।
হেল্প ডেস্ক থেকে ফরম পূরণসহ বিভিন্ন সেবা নিতে দেখা গেল সেবাগ্রহীতাদের। যাঁরা সেবা নিতে আসবেন, তাঁদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেকর্ড রুমের নথি পুনর্বিন্যাস, প্রধান সড়কে কার্যালয়ের নামফলক টাঙানো, নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি, কার্যালয়ে প্রবেশপথ সংস্কার করা, কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য ইউনিফর্ম, সবার জন্য পরিচয়পত্র দেওয়া এবং কর্মীদের জন্য ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষের সংস্কার করা হয়েছে। অভিযোগ বক্স ও নোটিশ বোর্ড টাঙানো হয়েছে। নামজারি ও জমা ভাগের ফরম বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য আলাদা বক্স রাখা হয়েছে। টয়লেট সংস্কার করে তার সামনে লেখা আছে ‘নারীরা অগ্রাধিকার পাবে’। কার্যালয়ের নামে আছে একটি ফেসবুক পেজও। তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ব্যক্তি, সিস্টেম এবং জনগণ নিজেই দুর্নীতির জন্য দায়ী। হয়তো অনেক বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, তবে চেষ্টা করলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব।’