স্টলের খরচ ওঠেনি, প্রত্যাশা ‘বিশেষ সুবিধা’
মহামারীর মধ্যে অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষায় স্বস্তি থাকলেও হিসাবের খেরোখাতা মিলছে না প্রকাশক-বিক্রেতাদের। মেলার সাজসজ্জা ও কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে পুঁজিতেই হাত দিতে হচ্ছে তাদের।
মন খারাপ করা এবারের বইমেলা শেষের আগের দিন রোববার হিসাবের খাতায় স্টল ও সাজসজ্জা নির্মাণের খরচই যেন মেলাতে পারছে না অনেক প্রকাশনী। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২৫ শতাংশও বিক্রি হয়নি বলে হতাশ প্রকাশকরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরকে গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাসের এই দু:সময়ে দেরিতে হলেও মেলা শুরু হওয়ায় কিছুটা হলেও আশাবাদী ছিলেন তারা।
তবে কিছু দিন না যেতেই সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হলে ‘লকডাউনের’ বাধ্যবাধকতা তাদের বড় লোকসানে ফেলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে লেখালেখি ও বই প্রকাশের মতো সৃজনশীল কাজকে গতিশীল রাখতে সরকারের আর্থিক প্রণোদনা চান তারা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বই কেনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়াসহ সংকটকালে এসব 'বিশেষ সুবিধা' পাবেন বলে প্রত্যাশা তাদের।
কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে নানা অনিশ্চয়তার পর ১৮ মার্চ শুরু হওয়া এবারের বইমেলা নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগে শেষ হচ্ছে। মহামারীর গুরুতর পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে ‘কঠোর লকডাউন’ শুরুর আগে সোমবার মেলা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এক প্রকাশক বলেন,"মহামারীতে এক বছরে অনেক দূরাবস্থা গেছে। ভেবেছিলাম বইমেলায় সেটা কিছুটা রিকভার করা যাবে। তবে লকডাউন পরিস্থিতি, বার বার মেলার সময়সূচি পরিবর্তন আমাদের বিপাকে ফেলেছে।
"মেলায় স্টলে নির্মাণে যে কাঠমিস্ত্রির খরচ হয়েছে, সেই টাকাটাও বিক্রি হয়নি।"
অন্য একপ্রকাশক বলেন, "প্যাভিলিয়ন নির্মাণ করতে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত চার লাখ টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। এছাড়া বিক্রয় কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ তো আছেই।"
আরেকজন বলেন," এবারের বইমেলায় প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সাধারণত সবাই বিকেলে বা সন্ধ্যায় বইমেলায় আসেন। কিন্তু সেখানে এবার শেষ হয়েছে ৫টায়। শেষের দিকে বেচাকেনা ভালো হলেও এবার লকডাউন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে। যাইহোক, ভবিষ্যতের আশায় রইলাম।"
এবারের মেলায় শিশু চত্বরে শিশু সাহিত্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকমের বই দিয়ে স্টল সাজালেও ক্রেতা-দর্শনার্থীর তেমন সাড়া মেলেনি। পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটির দিনে ছিল না 'শিশু প্রহর'।
করোনাভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ‘লকডাউনের’ সপ্তম দিন রোববার বইমেলায় বই দেখছেন বইপ্রেমীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিকরোনাভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ‘লকডাউনের’ সপ্তম দিন রোববার বইমেলায় বই দেখছেন বইপ্রেমীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিশিশু সাহিত্য প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান 'প্রগতি'র প্রকাশক আসরার মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,"এবছর করোনা পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বইমেলায় আসতে নিরাপদ বোধ করেননি। যারা এসেছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় খুবই কম।
"স্বাভাবিকভাবেই এবার লোকসান গুনতে হবে। কেননা স্টল নির্মাণ, বিক্রয় কর্মীদের বেতন ও মাসব্যাপী আনুষঙ্গিক খরচের বিষয় রয়েছে।"
জায়গা বরাদ্দ ও স্থানান্তর নিয়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে শেষের দিকে ক্রেতা-দর্শনার্থী না পেয়ে লিটল ম্যাগাজিনের ১৩৫টি স্টলের মধ্যে ১১৯টিই বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনে স্টল বন্ধ রাখে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
‘দ্রষ্টব্য’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক বলেন, “গাঁটের পয়সা খরচ করে ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু বাংলা একাডেমির বৈষম্যমূলক আচরণ ও লকডাউন আমাদের হতাশ করেছে।"
এমন আর্থিক ক্ষতির মধ্যেও মহামারীরকালে বাঙালির প্রাণের মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরে অনেক প্রকাশক কিছুটা স্বস্তিবোধের কথা জানিয়েছেন। তবে এক বছর ধরে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরবস্থা এবং মেলায় ক্ষতি বিবেচনায় সরকারি প্রণোদনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পলল প্রকাশনীর প্রকাশক খান মাহবুবুল আলম বলেন,"আমরা যারা প্রকাশক, তাদের প্রফিট মোটিভ অবজেক্টিভের সঙ্গে একটা সোশ্যাল মোটিভ অবজেক্টিভও আছে। সেই জায়গা থেকে মেলায় অংশগ্রহণ।
"এবার মেলাটা যে ফলপ্রসূ বা লাভজনক হবে না, সেটা আগে থেকেই জানতাম। তবুও আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কেননা মুজিববর্ষ এবং সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এটা একটা বড় রেসপন্সিবিটির বিষয় ছিল। তাছাড়া চারদিকে যে মৌলবাদী আন্দোলন, তার বিরুদ্ধে এই বইমেলা সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ ও জাগরণের বিষয়।"
প্রণোদনার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন," আশা করব, সরকার এই সেক্টরটাকে সার্বিকভাবে দেখভাল করবে। কেননা মহামারীকালেও সরকারের সহযাত্রী হয়ে বইমেলায় অংশ নিয়েছি। গত এক বছরের আমরা যে বই প্রকাশ করেছি, সেটার ৫০ শতাংশ রেট অব রিটার্ন মেলা থেকে চলে আসত। কিন্তু এবার তো সেটা হলো না।"
এদিকে সরকারের বিশেষ প্রণোদনার দাবি জানিয়ে ৫৪ জন প্রকাশকের সমন্বয়ে সংগঠিত 'পাবলিশার্স ফোরাম, কাঁটাবন' বাংলা একাডেমিকে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে চিঠি দিয়েছে।
সংগঠকরা বলেন,"আসলে পুরো বছরজুড়েই আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছি। শুধু বইমেলার ক্ষতিই নয়, পুরো বছরে যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার একটা বিবরণ বাংলা একাডেমিকে দিয়েছি। বাংলা একাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, সেখানে তারা বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে আশা করি।"
এবারের আয়োজনকে নিয়ম রক্ষা বা ধারাবাহিকতা রক্ষার বইমেলা হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন,"ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে আসা বইমেলা নিয়ে এবার অনিশ্চয়তা ছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে যাতে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমরা মেলাটা চেয়েছিলাম। সরকারও অনুমোদন দিয়েছে।
"তবে ব্যবসায়িক সহযোগিতায় কাজে আসেনি, শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে।"
ক্ষতি পোষাতে প্রণোদনার বিষয়ে তিনি বলেন,"আমরা মনে করি, সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। লিখিতভাবে আবেদন আগেও করেছি, এখনও করব। তবে এটা শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক ক্ষতি নয়, সারা বছরই প্রকাশকদের খারাপ সময় যাচ্ছে। সারা বছরের প্রেক্ষাপটে একটা দাবি তুলে ধরব।"
এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান বলেন,"প্রকাশকদের দাবির প্রেক্ষিতেই বাংলা একাডেমি এবছর বইমেলার আয়োজন করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার তারা শুরুতেই একটা বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। স্টল ভাড়ায় ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ গত বছর যেটা ১৫ হাজার টাকা ছিল, এবার অর্ধেক নেওয়া হয়েছে। এরপরও কারও দাবি থাকলে সরকার সেটা বিবেচনা করবে।"