South east bank ad

মার্কিন অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে অর্থনীতিবিদদের

 প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   আমদানী/রপ্তানী

মার্কিন অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে অর্থনীতিবিদদের

মন্দা ভাব কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় খাত ও শ্রেণীভেদে প্রবৃদ্ধির গতিধারার ব্যবধান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি হলে ওই পরিস্থিতিকে ‘কে-শেপড ইকোনমি’ বলে আখ্যা দেন অর্থনীতিবিদরা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিছু খাতে দেখা যায় ব্যাপক মাত্রার উল্লম্ফন। আবার কিছু খাতে পতনের গতি বেড়ে যায়। লেখচিত্রে তুলনাযোগ্য খাত বা শ্রেণীগুলোর এ বিপরীতমুখী গতি অনেকটা ইংরেজি ‘কে’ (K) অক্ষরের মতো দেখায়। অসামঞ্জস্যপূর্ণ এ পুনরুদ্ধার অর্থনীতিতে বৈষম্যের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন ঠিক এমনই এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিটির এ বিপত্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। খবর সিএনএন।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে। সাধারণ নাগরিকদের ব্যয় বাড়ছে আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। এ পরিস্থিতিতে ধনী পরিবারগুলোর অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও সাধারণ মানুষ চাপের মধ্যে রয়েছে। এ বৈষম্য মার্কিন অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। মার্কিন অর্থনীতির কে-শেপড পুনরুদ্ধারের গতি দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে টেকসই রাখতে ব্যর্থ হতে পারে। এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় একযোগে দেশটির অর্থনীতির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী শুক্রবার দেশটির হালনাগাদ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ করেছে স্থানীয় কমার্স ডিপার্টমেন্ট। এতে দেখা যায়, আগস্টে দেশটির ভোক্তাব্যয় বেড়েছে আগের মাসের তুলনায় দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে এ বৃদ্ধির হার (ভোক্তাব্যয়ের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি) দাঁড়ায় দশমিক ৪ শতাংশে। এ সময় ব্যক্তি পর্যায়ের গড় আয় বেড়েছে দশমিক ৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের পর প্রকৃত আয় দাঁড়ায় দশমিক ১ শতাংশে। আয় ও ব্যয়ের এ অসামঞ্জস্যের কারণে চাপ সামলাতে অনেকেই সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। আগস্টে সঞ্চয়হার নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত একটি সূচক হলো পার্সোনাল কনজাম্পশন এক্সপেন্ডিচারস (পিসিই) বা ব্যক্তি পর্যায়ের ভোগব্যয় সূচক। ফেডারেল রিজার্ভের সাধারণ লক্ষ্য হলো এটিকে ২ শতাংশে বেঁধে রাখা। মার্কিন কমার্স ডিপার্টমেন্টের তথ্যানুযায়ী, এ সময় পিসিই সূচকভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে, যা ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দেশটিতে এখন ভোক্তাব্যয়ের ধরনও বদলে যাচ্ছে। মার্কিন কমার্স ডিপার্টমেন্টের তথ্যানুযায়ী, এখন দেশটির মানুষের আয়ের বড় অংশ যাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও বীমার মতো অতিপ্রয়োজনীয় খাতে। আগস্টে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় দাঁড়িয়েছে মোট ভোক্তাব্যয়ের প্রায় ২৩ শতাংশে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি এসেছে মেডিকেয়ার ও মেডিকেইড থেকে। আগে খুচরা ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, হোটেল বা ভ্রমণ খাতে যে ব্যয় হতো, তা এখন কমছে। ফলে এসব খাতে এখন চাপ বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম জোসেফসন বলেন, ‘মানুষের পকেট থেকে বাধ্যতামূলক খাতে খরচ যত বাড়ে, অপরিহার্য নয় এমন খাতে (ডিসক্রিশনারি খাত যেমন রেস্তোরাঁয় খাওয়া, ভ্রমণ ও শখের জিনিস কেনা ইত্যাদি) ব্যয় তত কমে। এ ধরনের খাতে ব্যয় কমতে থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

কফি চেইন স্টারবাকসের যুক্তরাষ্ট্রে ৪০০ শাখা বন্ধ করে দেয়ার সর্বশেষ সিদ্ধান্তকে করপোরেট খাতের ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ার বড় উদাহরণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে প্রায় ৯০০ কর্মীকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণাও দিয়েছে কোম্পানিটি। ডিসক্রিশনারি খাতে ভোক্তাব্যয় কমতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে চাপে থাকা কর্মসংস্থানও আরো বিপত্তিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতির কার্যকর প্রয়োগ শুরু হয় আগস্টে। বিভিন্ন দেশের ওপর নানা মাত্রায় শুল্ক আরোপের কারণে দেশটিতে পণ্য আমদানির ব্যয় এখন বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ব্যয় এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে। তবে আগস্টের বিভিন্ন সময়ে কার্যকর হওয়ায় চলতি সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান প্রকাশ হওয়ার আগে দেশটির মূল্যস্ফীতিতে এ শুল্কনীতির প্রভাব স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে না। তবে ওষুধ আমদানিতে শতভাগ শুল্ক আরোপের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সামনের দিনগুলোয় মার্কিন ভোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলবে।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাব্যয়ের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে ধনী পরিবারগুলো। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডিস অ্যানালিটিকসের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) দেশটির ২০ শতাংশ ধনী পরিবার মোট ভোক্তাব্যয়ের প্রায় অর্ধেক বহন করেছে। বিপরীতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তুলনামূলকভাবে চাপে আছে। তাদের আয় সেভাবে না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে চলেছে। তাই সঞ্চয় ভাঙা ছাড়া তাদের হাতে কোনো উপায় নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাব্যয়ের প্রবৃদ্ধি মূলত ধনী পরিবারগুলোর ওপর নির্ভর করছে। এ অবস্থায় নতুন কোনো ধাক্কা এলে দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে।

মার্কিন অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে ভোক্তাদের মনোভাবও এখন নেতিবাচক। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের আস্থা রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর ভোক্তাদের মাঝে এমন হতাশা আর দেখা যায়নি।

মার্কিন আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নের্ডওয়ালেটের অর্থনীতিবিদ এলিজাবেথ রেন্টার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে ভোক্তাদের এমন নেতিবাচক মনোভাব এর আগে আমরা দেখেছি কেবল বৈশ্বিক মন্দার সময়। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ অর্থনীতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। কেবল শেয়ারবাজারে বড় অংকের বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলক স্বস্তিতে আছেন বলে জানিয়েছেন। কারণ তাদের সম্পদ অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানোর জন্য সুরক্ষা প্রদান করছে।’

আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যের দাম বেড়েছে দশমিক ৫ শতাংশ, যা মার্চের পর এক মাসে সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধি। এ সময় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশে। জ্বালানি ও গ্যাসের দামও আগস্টে বেড়েছে। তবে খাদ্য ও জ্বালানি বাদ দিলে মূল বা কোর পিসিই ইনডেক্স স্থির থেকেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশে। একই সময়ে সেবা খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

দেশটিতে বিদ্যুৎ, গৃহস্থালি ব্যয় ও গরুর মাংসের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে। দেশটিতে শুধু গরু ও ভেড়ার মাংস কেনার ব্যয়ই এক বছরে বেড়েছে প্রায় ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। গৃহস্থালি ইউটিলিটি খরচ বেড়েছে ৭ শতাংশ। এ ধরনের বৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য নতুন চাপ তৈরি করছে।

BBS cable ad

আমদানী/রপ্তানী এর আরও খবর: