অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য রফতানি প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৫.৬৪ শতাংশে

বাংলাদেশের পণ্য রফতানি খাত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১২ মাস শেষ করে নেতিবাচক বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানি কমেছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রফতানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যা গত পাঁচ অর্থবছরের একই সময়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রফতানি প্রবৃদ্ধি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে গতকাল প্রকাশিত হালনাগাদের সঙ্গে পূর্ববর্তী পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে।
গতকাল জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে রফতানি হয়েছে ১ হাজার ২৩১ কোটি ৩১ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ১ হাজার ১৬৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বা পণ্য রফতানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এক অংকে নেমে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। ওই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে হয় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি—৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যদিও গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ হিসাবেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই গত পাঁচ অর্থবছরের একই সময়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে, ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
দেশের রফতানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক। যা মোট রফতানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। ফলে এ পণ্যের রফতানির গতিপ্রকৃতি সার্বিক রফতানিতে প্রভাব ফেলে। পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে মোট রফতানিতে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির কারণও তৈরি পোশাক—এমনটিই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ মতামত ইপিবির পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এ মাসের তুলনায় পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জুলাই-আগস্ট দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। একক মাসভিত্তিক পরিস্থিতিও নেতিবাচক। আগস্টে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ধাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক রফতানি আয়েও প্রতিফলিত হয়েছে।’
তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে, কারণ বেশির ভাগ ক্রেতাই নতুন করে কোনো অর্ডার দিচ্ছে না—এ তথ্য উল্লেখ করে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘তারা এখন অতিরিক্ত ২০ শতাংশ রেসিপ্রোকাল শুল্কের একটি অংশ বাংলাদেশী সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। রফতানিকারকদের পক্ষে এ অতিরিক্ত চাপ বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, কারণ তারা এরই মধ্যে প্রাথমিক শুল্ক সমন্বয় এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবসহ বিভিন্ন ধরনের চাপে রয়েছে।’
বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য বাজারেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে বলে জানান হাতেম। তিনি বলেন, ‘চীনা ও ভারতীয় প্রস্তুতকারকরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসব বাজারে রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমরা আশঙ্কা করছি, এ ধীরগতি আগামী দুই-তিন মাস অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে আমাদের রফতানি আবারো পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করছি। এ সময়ে রফতানিকারকদের ধৈর্য সহকারে ক্রেতাদের যেকোনো ধরনের চাপ মোকাবেলা করতে হবে।’
গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববাজারে মোট ৩৬২ কোটি ৭৫ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রফতানি হয়েছিল ৩৮০ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য। এ হিসাবে অর্থমূল্য বিবেচনায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম রফতানি হয়েছে।
চলতি বছরের আগস্টেও ২০২৪ সালের এ মাসের তুলনায় মোট রফতানি কম হয়েছিল ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ওই সময় ইপিবি জানিয়েছিল, অর্থবছরের শুরুতে রফতানি পারদর্শিতায় দৃঢ়তা দেখালেও বিশ্ববাজারে চাহিদার ওঠানামা ও পরিবর্তনশীল বাজার পরিস্থিতি বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
গত সেপ্টেম্বরে রফতানির সবচেয়ে বড় পণ্য খাত তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল পণ্যের রফতানি কমেছে শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রধান পাঁচ রফতানি পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্যের রফতানিতে নেতিবাচক বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থমূল্য বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের মোট রফতানির ৮১ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। তিন মাসে তৈরি পোশাকের রফতানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রফতানি পণ্য চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। কৃষিপণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। মোট রফতানির ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ জুড়েই ছিল এ পাঁচ পণ্য।
ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের ওভেন পণ্যে নিটওয়্যারের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কৃষিপণ্যের মধ্যে ফল ও সবজি রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাপক হারে—যথাক্রমে ৬৯ ও ৪৭ শতাংশ। চামড়াজাত পণ্যে রফতানি হয়েছে ২৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। পাটজাত সুতা রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ, পাটের বস্তা রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬১ শতাংশ।